জেলা সম্পর্কে

নরসিংদীর জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং নাম করণঃ-

আমি রত্নভূমি নরসিংদীর সন্তান। নরসিংদীর সন্তান হিসেবে আমি গর্বিত। নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার কাঁচিকাটা ইউনিয়নের বড় মির্জাপুর গ্রামের খন্দকার বাড়ীতে আমার জন্ম।

নরসিংদীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং নরসিংদী শহরের নামকরণ নিয়ে আমার সংগ্রহকৃত ও সংকলিত লিখাটি “খেয়া” খন্দকার বাড়ীর সৌজন্যে এখানে পোস্ট করা হলোঃ-

নরসিংদীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও ঐতিহ্যঃ-

৬৯ সালের গণ আন্দোলনের শহীদ ‘আসাদ’ এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ বীরশ্রেষ্ট ফ্লাইট লেফটেনেন্ট ‘মতিউর’ রহমানের জন্মভূমি নরসিংদী। শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে যারা আলোকবর্তিকা প্রজ্জ্বলিত করে নরসিংদীকে ঐতিহ্যমন্ডিত করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন উপমহাদেশের প্রথম বাঙালি আই.সি.এস. অফিসার স্যার কে.জি. গুপ্ত, গবেষক ও পবিত্র কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক ভাই গিরিশ চনদ্র সেন। ১৮৩৫ সালে গিরিশচন্দ্র সেন নরসিংদীর পাঁচদোনায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইসলামী সাহিত্য সাধনা করে ১৮৮৬ সালে প্রথম পবিত্র কুরআনের বঙ্গানুবাদ সম্পন্ন করেন। বাংলা সাহিত্যে এটাই তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি। ধর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ, চারিত্রিক উদারতা এবং সত্যবাদিতার জন্য গিরিশচন্দ্র সেন সব মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করেন এবং তিনি ছিলেন সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রতীক। তাই সকলে তাকে :ভাই গিরিশচন্দ্র” নামে ডাকত। ১৯১০ সালে গিরিশচন্দ্র সেনের কর্মময় জীবনের অবসান হয়। নরসিংদীর কৃতি সন্তান হিসেবে যাঁরা চিরকস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন তাঁরা হচ্ছেন বিখ্যাত কবিয়াল হরিচরণ আচার্য, যিনি ‘কবিগুণাকর’’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন, মৌলভী সেকান্দর আলী এবং কবি দ্বিজদাস। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি শামসুর রাহমান, প্রাবন্ধিক ও সমালোচক ড.আলাউদ্দি আল আজাদ, এবং দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সম্পাদক আহমদুল কবির মনু মিয়া নরসিংদী জেলারই গর্ব। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের বরনীয় শিল্পী মুক্তিযোদ্ধা আপেল মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড: আবদুল মান্নান, বর্তমান ভিসি আ.আ.স.ম. আরেফিন সিদ্দিক এবং সাবেক সেনা বাহিনীর প্রধান ও সাবেক মন্ত্রী জেনারেল নূরুদ্দিন খান এ জেলারই কৃতি সন্তানদের মধ্যে অন্যতম। রাজনীতিক সুন্দর আলী গান্ধী, সতিশ পাকরাশী, কবিরাজ ললিত মোহন দাস, কামিনী কিশোর মল্লিক ও বিজয় চ্যাটার্জী এই জেলারই সন্তান।

ভৌগোলিক পরিচিতিঃ-

নরসিংদীর উত্তরে কিশোরগঞ্জ, দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। পূর্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জ এবং পশ্চিমে গাজীপুর জেলা। নরসিংদী জেলার আয়তন ১ হাজার ১৪০ দশমিক ৭৬ বর্গকিলোমিটার। নরসিংদী সদর, শিবপুর, পলাশ, মনোহরদী, রায়পুরা ও বেলাব উপজেলা এই ৬টি উপজেলা নিয়ে নরসিংদী জেলা গঠিত। ১৯৭৮ সালে নরসিংদী মহকুমা এবং ১৯৮৪ সালে নরসিংদীকে একটি পূর্ণাঙ্গ জেলায় পরিণত করা হয়। প্রধান নদীগুলো হচ্ছে মেঘনা, আড়িয়াল খাঁ, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, হাঁড়ীধোয়া, শীতলক্ষ্যা ও কলাগাছিয়া।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিঃ-

মহান মুক্তিযুদ্ধেও গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টিতেও নরসিংদীর ঐতিহ্য রয়েছে। শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্বাধিকার আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে নরসিংদীর রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অবদান। সারা বাংলাদেশের মতো নরসিংদীতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নরসিংদী ৩ নং সেক্টরের অধীনে ছিল। ১৯৭১-এ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এ জেলার বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চালিয়েছে। হত্যা করেছে ছাত্র, শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিকামী নিরীহ মানুষ। এ জেলায় আছে অনেক বধ্যভূমি। তবে সেসব স্মৃতি এখন অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। ১৯৭১-এর ২৮ আগস্ট সকালে বর্বর পাকিস্তানি সেনারা নরসিংদী মহাবিদ্যালয়ে ঢুকে সরজকুমার নাথ, শিক্ষক রাধাগোবিন্দ সাহাসহ ২৭/২৮ জনকে ধরে নিয়ে আসে। হায়েনারা ওইদিন রাতের আঁধারে সবাইকে পাঁচদোনা সেতুর ওপর দাঁড় করে গুলি করে হত্যা করে। সেই স্মৃতি চিহ্ন নিয়ে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে পাঁচদোনা সেতু।

নরসিংদী জেলার ঐতিহ্যঃ-

নরসিংদী জেলার একটি বিশেষ এবং উলে­খযোগ্য ঐতিহ্য হচ্ছে তাঁত শিল্প। নরসিংদী হচ্ছে তাঁতবস্ত্রের জন্য বিখ্যাত জনপদ। ‘প্রাচ্যের ম্যানচেষ্টার’ বলে খ্যাত শেখেরচর (বাবুরহাট) এ জেলায় অবস্থিত। বাংলাদেশের তাঁত বস্ত্রের চাহিদার প্রায় সিংহভাগ পূরণ করছে এ জেলার তাঁত শিল্প।

কলা, কাঁকরোল, শশা, সিম,বেগুন ,ধান, পাট, আলু ও লটকন উৎপাদনে উলে­খযোগ্য নরসিংদী বাংলাদেশের একটি অন্যতম কৃষি সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে পরিচিত হয়েছে।

সভ্যতার নিদর্শনঃ-

নরসিংদী জেলা বাংলাদেশের একটি সুপ্রাচীন সমৃদ্ধ জেলা। এ জেলার বেলাব উপজেলার ‘ওয়ারী বটেশ্বর’ গ্রামে পরিত্যক্ত ভিটা ও অসমরাজার গড় আবিস্কৃত হয়েছে। যা নব্য প্রস্তর যুগীয় সভ্যতার নিদর্শন। ওয়ারীতে খৃষ্টপূর্বকালের ছাপাঙ্কিত পর্যাপ্ত রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া গেছে। এসব মুদ্রা নরসিংদী অঞ্চলের আদি সভ্যতার স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।

নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার ‘জয়মঙ্গল’নামে পাহাড়ী গ্রামে আবিস্কৃত হয়েছে গুপ্তযুগের স্বর্ণমুদ্রা একই উপজেলার আশ্রাফপুরে আবিস্কৃত হয়েছে সপ্তম শতাব্দীর মহারাজা দেব খড়গের তাম্রলিপি এবং অষ্টধাতুর নির্মিত বৌদ্ধ নিবেদন স্ত্তপ। এই আশ্রাফপুরেই আবিস্কৃত হয়েছে গৌড়ের স্বাধীন নরপতি আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পুত্র সুলতান নাসির উদ্দিন নসরৎ শাহের রাজত্বকালে নির্মিত একটি অতি প্রাচীন মসজিদ।

পলাশ উপজেলার পারুলিয়া গ্রামে আনুমানিক ১৭১৬ খ্রিষ্টাব্দে দেওয়ান শরীফ ও তার স্ত্রী জয়নব বিবি নির্মিত মোগল স্থাপত্যরীতির একটি প্রাচীন মসজিদ রয়েছে।

এ অঞ্চলের জনসাধারণের আধ্যাতিক ও নৈতিক জীবনে যাঁদের প্রভাব আলোকবর্তিকা রূপে কাজ করেছে সে সব পীর আউলিয়াদের পবিত্র মাজার শরীফ রয়েছে। নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনের অনতিদুরে পশ্চিমদিকে তরোয়া গ্রামে হযরত কাবুল শাহের মাজার, কুমরাদী গ্রামে হযরত শাহ মনসুরের মাজার, পাটুলী ইউনিয়নের হযরত শাহ ইরানীমাজার, ওয়ারী গ্রামে হযরত সোলায়মানের মাজার এবং পারুলিয়া দেওয়ান সাহেবের মাজার বিশেষভাবে উলে­খযোগ্য।

নরসিংদী শহরের নামকরণের ইতিহাসঃ-
রাজা নরসিংহের নরসিংদী। হাবসী শাসনামলের শেষ পর্যায়ে সোনারগাঁও অঞ্চলের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে শীতলক্ষ্যার তীরে হিন্দু জমিদার ধনপদ সিংহ রাজা খেতাব গ্রহণ করেন। রাজা ধনপদ সিংহের পুত্র নরসিংহী বাবার জমিদারির সীমা বৃদ্ধি করে প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে, নগর নরসিংহপুর নামে একটি ছোট্ট শহর প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজের আবাসিক স্থান তৈরি করেন। বর্তমানে পলাশ উপজেলার পারুলিয়া গ্রামটিই সেই শহর।

ধারণা করা হয়, রাজা নরসিংহের নাম থেকেই নরসিংদী নামকরণ হয়েছে। নরসিংদীর সঙ্গে “দী” শব্দটির একটি ব্যাখ্যা আছে। প্রাচীনকালে শব্দটি ছিল “ডিহি”। সংস্কৃত ভাষায় “ডিহি” শব্দের অর্থ হলো ডাঙা। নরসিংদী একটি উঁচু অঞ্চল। সেই কারণেই স্বভাবতই এর নাম ছিল নরসিংহ “ডিহি”। পরবর্তীতে সাধারণের মুখে মুখে এর নাম হয়েছে “নরসিংহদী”। বর্তমান সময়ে “হ” বিলুপ্ত হয়ে নাম হয়েছে নরসিংদী। আবার অনেকেরই ধারণা, এখানকার আদিবাসীরা সিংহের মতই পরাক্রমশালী ছিলেন বলে এ স্থানের নামকরণ করা হয়েছে নরসিংদী। অন্য একটি সুত্রে জানা যায়, সেন রাজারা শহরে বিষ্ণুর নরসিংহ অবতার রুপ একটি মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই থেকে এই অঞ্চলের নাম নরসিংদী।

স্বাগতম আপনাদের আমাদের ওয়েব সাইট ভিজিট করার জন্য। "নবমপরশ" নরসিংদী জেলা নির্দেশিকা বইটি ক্রয় করতে যোগাযোগ করুন- লেখক আসাদ ভূঁইয়া > ০১৮১৯৫২৭৬৮৭